আমার শিক্ষকদের মধ্যে যে মানুষটিকে আভিজাত্যের অনন্য উচ্চতায় দর্শন করি, তিনি স্বর্গীয় যোগেন্দ্র চন্দ্র রায়। তাঁর মতো করে ধুতি-পাঞ্জাবি-নাগড়া পড়া পুরুষ দেখিনি। তিনি আধাকাঁচা চুলে বেকব্রাশ করতেন, ধবধবে ফর্শা মানুষটিকে সত্যিই অসাধারণ মনে হতো। তাঁর চোখ রাঙানোকে অবজ্ঞা করার মত দুর্বিনীত ছাত্র কোন কালেই ছিল না। তাঁকে ধুতি-পাঞ্জাবি-নাগড়ায় অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ মনে হতো। একসময় বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ধুতি-পাঞ্জাবি পড়তো। আমাদের সময় এচল (ফ্যাশন) উঠে যায়। আমাদের সময় শুধু হিন্দু ধর্মালম্বীরাই ধুতি-পাঞ্জাবি পড়তেন। আমাদের পন্ডিত (যতীন্দ্র নাথ চক্রবর্তী) স্যার, গোপাল (চন্দ্র দাস) স্যারও ধুতি পড়তেন। তবে ধুতির কুচির প্রান্তটাকে পাঞ্জাবির পকেটে গুজে ধুতি পড়ার যে অনন্য দর্শন তা কেবল যোগেন স্যারের জন্য নির্ধারিত ছিল। আজ অবধি অন্য কাউকে এরূপ দর্শনে দেখিনি। তিনি যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তিনি স্কুলে কর্মরত ছিলেন। যে চেয়ারে বসে তিনি প্রবল প্রতাপে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতেন। সেই চেয়ারে বসেই হার্টএটাকে মৃত্যুবরণ করেন। যা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। মৃত্যুর সংবাদ আমি দু’দিন পর পেয়েছিলাম। মহসিনের কাছে শুনেছিলাম, ইতি ম্যাডাম (স্যারের স্ত্রী), তিনি হিন্দু রীতি অনুযায়ী বিগতপ্রাণ স্বামীর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে শিথীর সিঁধুর মুছে নিচ্ছিলেন। তখন অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে বলতে ছিলেন ‘তুমি আমাকে ছেড়ে একদিনের জন্য কোথাও যাওনি, আজ তুমি একি করলে, আমাকে একা রেখে চলে গেলে।’ ম্যাডামের নাম ইতি রানী রায়। তিনি নারায়ণগঞ্জের আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও পরে মরগ্যান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। একদিন স্কুলে সিনিয়র ছাত্রদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। স্যার হইচই শুনে তাঁর কক্ষথেকে বের হয়ে অত্যন্ত দ্রুত পায়ে স্কুলের পূর্ব পাশে ছুটে গেলেন। স্যার আসতেছে শুনে বিবাদমান ছাত্ররা দেয়াল টপকে পোদ্দার বাড়ির পুকুরপাড়ে পালিয়ে যায়। কে বলবে কিছুক্ষণ আগে এখানে মারামারি হচ্ছিল। কোন শিক্ষককে এ মাত্রায় সমীহ করতে আমার শিক্ষাজীবনে, চাকুরিজীবনে দেখিনি। স্কুলের প্রতিটি অনুষ্ঠান চলাকালে তিনি ছাত্র সমাবেশের মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। এমনকি মিলাদের অনুষ্ঠানেও তিনি এরূপ অবনত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। এর অর্থ হলো, দুষ্টু ছেলেদের নড়াচড়া করা, কথা বলা সব বন্ধ। স্যার আমাদের ক্লাশ নাইনে ‘ওয়াইজ ম্যান অব দি ওল্ড’ প্রবন্ধ ও ‘হ্যাপি দ্যা ম্যান’ কবিতা পড়াতেন। স্যারের অনুপ্রেরণায় আমি উক্ত প্রবন্ধের প্রথম পৃষ্ঠা মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। আজ থেকে প্রায় ৪৩ বছর আগের কথা। মাঝে মাঝে আওড়ে দেখি আজও তা আগের মতই মুখস্থ বলতে পারি। যোগেন স্যারের অনুপ্রেরণা বলে কথা। স্যার ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার খিদিরপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম তারক চন্দ্র রায় ও মাতার নাম বসন্ত কুমারী রায়। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মশুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। পরবর্তীতে মুন্সিগঞ্জ জেলার ‘হরগঙ্গা কলেজ’ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি তাঁর জন্মস্থান, খিদিরপুরের প্রথম স্নাতক ছিলেন। স্বর্গীয় যোগেন্দ্র চন্দ্র রায় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ১৩ টাকা বেতনে বি.এম. ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি শেঠ তোলারাম মহিলা কলেজ (বর্তমান সরকারি তোলারাম কলেজ) এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ১৯৭২ সালে বি.এম. ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৩ বছর তিনি এই উভয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বয়সজনিত কারণে উচ্চ রক্তচাপে ভুগতেন। তাছাড়া তিনি পারিবারিক ও মানসিক চাপেও ছিলেন। তবে তিনি তা কখনও কারও সঙ্গে শেয়ার করতেন না। যে চেয়ারে বসে স্কুুল পরিচালনা করতেন সেই চেয়ারে থাকা অবস্থায় তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের চির সমাপ্তি ঘটে। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯খ্রি. তারিখে তিনি দেহত্যাগ করেন। স্বর্গীয় যোগেন্দ্র চন্দ্র রায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অধ্যয়নকালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছিলেন। স্যার সরকারি তোলারাম কলেজে বাণিজ্য ভূগোল পড়াতেন। যে দিন কলেজে ক্লাশ থাকতো তিনি একটু দেরি করে স্কুলে আসতেন। যতটুকু মনে করতে পাড়ছি, তিনি স্কুল-গোদারা ঘাট থেকে মাঝে মাঝে হেটে স্কুলে আসতেন। তিনি সবসময় ফাইলপত্র হাতে করে হেটে আসতেন। পান খেয়ে মুখ রাঙিয়ে রাখতেন। চায়েও অভ্যস্থ ছিলেন- রাজসিক ভঙ্গিতে চা পান করতেন। ১৯৭৮ সাল, আমাদের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বেড়িয়েছে। আমাদের মনে তখন নানা চিন্তা; অজানা ভয়ে-আতঙ্কে কুঁকড়ে আছি। একদিন ভোর রাতের আমার আব্বা শুনতে পেলেন কে একজন আমাকে নাম ধরে অর্থাৎ খলিল বলে রাস্তা থেকে ডাকছেন। আব্বা জানালার পাশে গিয়ে দেখলেন, হেড স্যার। আব্বা ‘আদাব স্যার’ বলতেই তিনি আমার পরীক্ষার ফলাফল জানালেন। তিনি আব্বাকে মোহসিনের স্ট্যান্ড করার কথাও জানালেন। পরে জেনেছি সারা রাত ট্যাবুলেশনের কাজ শেষ করে, পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করে, নিশ্চিত হয়ে সোজা বন্দর চলে এসেছেন। অনেকদিন পর বন্দর স্কুলে এত ভাল রেজাল্ট হয়েছে। সকল কৃতিত্ব-আনন্দ একমনে ধরে তিনি ছুটছেন আনন্দ ভাগাভাগি করতে। আমরা সকাল-সকাল স্কুলে ছুটে গেছি। স্যার ততক্ষণে নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি নিয়ে বাসায় চলে গেছেন। স্যার ইহলোকে নেই, অনেকদিন। তিনি প্রায় ৭ (সাত) বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে বি.এম.ইউনিয়ন হাই স্কুলে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সময়কালকে স্কুলের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। তিনি একজন শিক্ষক, প্রশাসক ও অনন্য অভিভাবক ছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালে স্কুলের নাটকে বিচারকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। নাটকটি নাম ‘চোর’। নাটকটি সিরাজদৌলা ক্লাবের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন আমি ৮ম শ্রেণির ছাত্র। আব্দুল হাই দুর্বার স্যার নাটকটি পরিচালনা করেছেন। ধবধবে আলোয় বিচারক হিসেবে ফর্সা যোগেন স্যারকে অসাধারণ লাগছিল। পৌরুষদীপ্ত তাঁর সেই রূপ, আজও আমার চোখে লেগে আছে। আমি পেশগত জীবনে দীর্ঘদিন বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছি। নিজেকে এজলাসে কখনও ঐ মাত্রায় উন্নীত করতে পেরেছি বলে মনে করি না। বন্দরের অভ্যন্তরীণ চলাচলে তিনি রিক্সা ব্যবহার করতেন। চলার সময় পথচারিদের সকলেই স্যারকে চিনতো, তাঁকে আদাব, নমস্কার দিতেন। সে দৃশ্য দেখলে মনে হতো কোন রাজাধিরাজ যাচ্ছেন, আর সকলে তাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। তিনি মৃদু হেসে সালামের উত্তর দিচ্ছেন। এর সবই আজ দূর অতীত, আমার একান্ত কল্পনা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সদালাপী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। সর্বক্ষণ একটা হাসি তার মুখে লেগেই থাকতো। শিক্ষকতার বাইরে তিনি একজন মঞ্চাভিনেতা, ধর্মাচারী ও সমাজ সেবক ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, পাঁচ ছেলে, দুই মেয়ে এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। অল্পদিনের ব্যাবধানে তাঁর স্ত্রীও স্বর্গবাসী হন। তাঁর পুত্রদের সকলেই সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সিঙ্গাইরে সহকারী কমিশনার(ভূমি) হিসেবে কাজ করার সময় স্যারে তৃতীয় পুত্র রাম শঙ্কর রায়, আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি সেখানে পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম ছিলেন। একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। এ সময় একটি জাতীয় নির্বাচনে তাকে একটি চ্যালেঞ্জিং নির্বাচনী কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। তিনি দক্ষতার সাথে তা প্রতিপালন করে তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। দাদার সাথে বরাবরই আমার একটা সখ্যতা বজায় আছে। স্যারের ব্যক্তিগত তথ্যগুলো রাম’দা আমাকে সরবরাহ করেছেন। আমি মহান দার্শনিক সক্রেটিসকে (৪৭০-৩৯৯খ্রিস্টপূর্ব) দেখিনি, সুযোগও নেই। তাঁর সম্বন্ধে অনেকটুকুই স্যারের কাছ থেকে জেনেছি। তিনি তা আমাদেরকে পড়িয়েছেন। পাঠ্য বইয়ের বাইরে স্যার একদিন এনসাইক্লোপিডিয়া এনে সক্রেটিস সম্পর্কে পড়ে শুনিয়েছিলেন। এথেন্স তাই আমার নিকট জ্ঞানের পূণ্যভূমি। আর এথেন্স মানে আমার ভূবনের সক্রেটিস। এ টানে আমি একদিন এথেন্স গিয়েছিলাম। সেখানে এক্রোপলিস, এথেনা মন্দির, অলিম্পিয়াড, প্ল্যাটোর একাডেমিয়া, এম্ফিথিয়েটার ছুঁয়ে দেখেছি। যে জেলখানায় বন্দী সক্রেটিসের জীবনের শেষকটি দিন নির্মমভাবে কেটে গেছে, সেই জেলখানাটি আমি দেখতে গিয়েছিলাম। জেলখানার সামনে দাঁড়িয়ে সক্রেটিসের হেমলক পানের দৃশ্য কল্পনা করেছি। প্রবল ব্যক্তিত্বশালী সক্রেটিসকে কাছ থেকে দেখতে পাইনি ক্ষতি নেই, আমি যোগেন্দ্র চন্দ্র রায়কে দেখেছি।–খলিলুর রহমান