প্রবল চন্দ্র বসাক স্যারকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি, অনেক শ্রদ্ধা। তিনি ১৯৪৭ সালে ৩ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বড়রিয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত বসাক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কুটশ্বর চন্দ্র বসাক। তিনি বিবেকানন্দ হাই স্কুল থেকে এসএসসি এবং করটিয়া সরকারি সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএসসি, এমএড ডিগ্রি নেন। তিনি ১৯৬৮ সালে ২০ জানুয়ারি তারিখে বিএম ইউনিয়ন হাই স্কুলে বিএসসি শিক্ষক হিসেবে যোগদান কলেন। এ স্কুল থেকেই ২০০৭ সালে ২ জানুয়ারি তারিখে তিনি তার চাকরি জীবনের সমাপ্তি টানেন। আমাদের সময় ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কটি ছিল দূরবর্তী থাকার। তবে আমার সাথে স্যারের সম্পর্কটি নিবিড় ছিল। বিশেষ করে ১৯৭৬ সালে আমি যখন পারিবারিক কারণে স্কুল ছেড়ে চলে যাই সে সময়ে শিক্ষকদের মধ্যে কেবল বসাক স্যারের সাথেই পত্র যোগাযোগ ছিল। ১৯৭৭ সালে আবার এ স্কুলে ফিরে আসার ব্যাপারেও তাঁর অনুপ্রেরণা ছিল। ডালপট্টির রশিদ বিল্ডিংয়ের চারতলার ছাদে একটি কক্ষে তিনি থাকতেন, ৩০ বছরের বেশী সময় তিনি এ কক্ষটিতে কাটিয়েছেন। ছাদের এ কক্ষটি শীত গ্রীষ্ম সকল ঋতুতেই বিকেলে বেশ গরম অনুভূত হতো। একটি টেবিল ফ্যান, এ গরম বাতাসকে ঠান্ডা করতে পারতো না। আমাদের পড়াশোনাও চলতো এ কক্ষে। তিনি পোষাক আশাকে লেফাদুরস্থ ছিলেন। ইস্ত্রি করা একটি জামা একদিন পড়তেন। সাদা হাফ সার্ট ছিল তার পছন্দের জামা, সাদা সার্ট আর কালো প্যান্টে স্যারকে মানাতও বেশ। তার ধর্মাচার সীমিত, কথা বলতেন গুছিয়ে, অভিজাত আচরণ, তবে তার দৃষ্টির বৈভব ছিল সর্বব্যাপী-সর্বত্র। তিনি তাঁর কর্মকালে সফলভাবে অনেক মেধাবী ছাত্র উপহার দেন। যে কারণে তাকে কোনদিন পেশাগতভাবে হতাশ দেখা যায় নি। প্রবল স্যার আমাদের ক্লাশে বিজ্ঞান (রসায়ন) ও গণিত পড়াতেন। তাঁর পড়ানো বিজ্ঞান আমি কোনদিন মুখস্থ করিনি। পরবর্তী জীবনেও অর্থাৎ কৃষির মতো একটি ফলিত বিজ্ঞান পড়তে গিয়েও মুখস্থ করতে হয়নি। তিনি আমাদেরকে বিজ্ঞান বুঝাতেন, বুঝে পড়তে শিখিয়েছেন। বসাক স্যার যখন গণিত পড়াতেন, প্রতিটি গণিত নিয়ে ছিল তাঁর একটি গল্প, অংকটি (গণিত অর্থে) ভুলে গেলেও গল্পটি মনে থাকতো। গল্পটি মনে থাকলে আর অঙ্কটা ভোলা সম্ভব ছিল না। ক্লাশে ব্লাকবোর্ডে তিনি একটি অঙ্ক একবারই কষতেন। অঙ্কের ফল যদি না মিলতো, বইয়ের ফলটি কেটে শুদ্ধ করে দিতেন। বিষয়টি এমন যে বসাক কখনও ভুল করতে পারে না। এমন পেশাগত দক্ষ মানুষ আমার জীবনে খুব কম পেয়েছি। প্রবল স্যার কখনও অন্যের পেশা নিয়ে কোন মন্তব্য করতেন না। আমার চাকুরি জীবনে এর উল্টো রূপ দেখেছি। নিজের পেশা বাদে অন্য পেশায় সকলেই দক্ষতা দেখাতে ব্যস্ত, যা বাস্তবে অসম্ভব। হয়তো এ কারণেই অনেকক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের বড় অভাব পরিদৃষ্ট হচ্ছে। তিনি হেয়ালি করে আমাকে বলেছিলেন, তিনি নাকি আমার চেয়ে মনোযোগী ছাত্র পড়ান নি। হয়তো পড়িয়েছেন কিন্তু এ বাক্যটি আমার জীবনের সকল শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের অনির্বান উৎস। শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে সর্বদা এঁটা মনে রাখার চেষ্টা করেছি, অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছি। আমরা যখন স্কুলের ছাত্র তখন তিনি অবিবাহিত। তবে তিনি সাপ্তাহিক বন্ধের দিনটি টাঙ্গাইল কাটাতেন। আমাদের পাশ করার পর ১৯৭৮ সালে তিনি বিয়ে করে সংসারী হয়েছিলেন। তিনি মিতাচারী, স্বল্পাহারী, পেশাচ্ছন্ন ছিলেন। রিক্সায় চড়ে বাসা থেকে স্কুলে আসতেন। তিনি যখন হাটতেন তার হাটার একটি আলাদা ঠাট ছিল। তাঁর পছন্দের জুতো ছিল সাইকেল স্যু। স্যারের সাথে সর্বশেষ কবে কোথায় শেষ দেখা হয়েছিল আজ আর তা মনে করতে পারছি না। তবে ২০১৫ সালে গোপালগঞ্জে জেলাপ্রশাসক থাকা কালে আমি স্যারকে ফোন করে কুশলাদি জেনেছিলাম। চাকুরির কারণে আমার দেখা করতে যাওয়া কষ্টকর ছিল। আমি জেলাপ্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় তিনি খুশী হয়েছিলেন আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। সেদিন আমি স্যারকে গোপালগঞ্জে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠাতে চেয়েছিলাম। তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে যেতে রাজি হন নি। তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ, স্থায়ীভাবে টাঙ্গাইল বসবাস করেন। তবে কমিশনার হিসেবে টাঙ্গাইল পরিদর্শনে গেলে অনেক খোঁজেও তাঁর পরিবারের সন্ধান করতে পারিনি। অবশেষে আমার ডাইরির এক জায়গায় স্যারের নামের পাশে ‘মুন ফার্মেসি’ লিখা ছিল। সেই সূত্রধরে জেলা প্রশাসক, টাঙ্গাইলের সহায়তায় স্যারের পরিবারের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। স্যারের একমাত্র মেয়ে মুন বসাক এর সাথে কথা হয়েছে। মুন এমএ পাশ করেছে, লক্ষ্মী মা আমার, আমাকে অনুরোধ করেছে তাদের দেখতে যাওয়ার জন্য। তার কাছেই শুনলাম মুনের মা স্টোকে আক্রান্ত হয়ে সয্যাশায়ী। অবসর সময়ে স্যার সিনেমা দেখতেন, তবে সিনেমা নিয়ে কোনদিন আমাদের সাথে আলোচনা করতেন না। তাঁর বন্ধুর সংখা নিতান্তই হাতে গোনা কয়েক জন ছিল। যে কারণে লেখাপড়ার বাইরে কোন আড্ডা দিতে দেখা যায়নি। স্যারকে জীবনে কখনও রাগতে দেখিনি। সদা হাস্যোজ্বল এ ব্যক্তিটি স্কুল থেকে অবসর গ্রহণের পরও বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। শেষ জীবনে ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানাবিধ রোগে ভোগেছেন।পরপর ৪টি মাইল্ড স্টোকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি জন্মভূমি টাঙাইল চলে যান। বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর ২০১৫ সালে ১৫ এপ্রিল টাঙ্গাইলের বড়কালি বাড়ি, আদালত রোডস্থ নিজ বাসভবনে ৭২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তাঁর মেধা-শ্রম যা আমাদেরকে মানুষ হিসেবে, কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। -মো. খলিলুর রহমান।